আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক তার ঘনিষ্ঠ পাঁচ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৭৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৯ ও ২০২০ সালের বিভিন্ন সময়ে ৪০ দফায় ওই টাকা গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন তদবির বাণিজ্যে অংশ নিয়ে আনিসুল হক আত্মীয়দের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের এ ঘুষ গ্রহণ করেন। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) সূত্রে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে দেখা যায়, চতুর আনিসুল হক ঘুষ বা অবৈধ আয় গ্রহণে তার ব্যবসায়িক বন্ধু, মা, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাগিনা ও কথিত বান্ধবী তৌফিকা করিমের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন। ওই ব্যাংক হিসাবগুলোর একমাত্র নমিনি ছিলেন তিনি। মায়ের ক্ষেত্রে নমিনি হওয়ার যৌক্তিক কারণ থাকলেও অন্য ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক হিসাবগুলোর নমিনিতে তার নাম থাকার বিষয়টি সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যে ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক হিসাবগুলোর বিবরণী দুদকেও জমা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, একমাত্র নমিনি হিসেবে আনিসুল হকের নাম থাকা ঘনিষ্ঠ পাঁচজনের অ্যাকাউন্টে ওই সময়ে ৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা নগদ বা ক্যাশ হিসাবে জমা হয়। অর্থগুলো কোনো ব্যাংক হিসাব থেকে তাদের হিসাবে স্থানান্তর হয়নি। সরাসরি জমা হয়েছে, যা থেকে মূলত সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অর্থের উৎস গোপন করতেই এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। ফ্রিজ করা হয়েছে ২৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৪০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। মামলা হয়েছে আনিসুল হকের কথিত বান্ধবী তৌফিকা আফতাব ওরফে তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধেও। তার বিরুদ্ধে ৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়েছে।
অনিসুল হকের মামলার অগ্রগতিসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, তার (অনিসুল হক) বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ ও সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার পর তদন্ত কার্যক্রম চলমান। তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কমিশন পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেবেন।
আনিসুল হক তার ঘনিষ্ঠ পাঁচ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে নগদ ৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, এমন আরও ব্যক্তি রয়েছেন যাদের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়া হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সবগুলোর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারলেও ঘনিষ্ঠ পাঁচজনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ঘুষের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে দুদক। ওই পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন-আনিসুল হকের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ ইকবাল (ব্যাংক হিসাবের নাম)। যার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের একাউন্ডে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে সাত দফায় নগদ ১২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জমা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে এককালীন সর্বোচ্চ চার কোটি ৯৯ লাখ টাকা নগদ জমার তথ্য রয়েছে।
অন্যদিকে, আনিসুল হক ঘুষ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে তার মা জাহানারা হকের ব্যাংক হিসাবও ব্যবহার করেছেন। ১২ দফায় একই ব্যাংকের হিসাবে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা নগদ জমা হয়েছিল। যার মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। একইভাবে তার ছোট ভাইয়ের বউ জেবুন্নেসা বেগম হকের হিসাবে ২০১৯ সালে চার দফায় চার কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং তার ভাগিনা এস কে মো. ইফতেখারুল ইসলামের হিসাবে ১১ দফায় ২৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা নগদ জমা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এককালীন সর্বোচ্চ ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। আনিসুল হকের কথিত বান্ধবী তৌফিকা করিমের ব্যাংক হিসাবেও ছয় দফায় চার কোটি ৭৫ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তাদের সবার হিসাবের একমাত্র নমিনি হলেন আনিসুল হক।
গত ১ জানুয়ারি ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৪ সালে ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে অনিসুল হক অসদাচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ ৭০ হাজার ৯৬ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এছাড়া তার ২৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩৪৯ কোটি ১৫ লাখ ২১ হাজার ৫৮২ টাকা জমা এবং ৩১৬ কোটি ৪৮ লাখ ৮১ হাজার ৬০৮ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে। তার বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪-এর ২৭ (১) ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারা তৎসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে এজাহারে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আনিসুল হক সংশ্লিষ্ট ২৭টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়। তার মধ্যে আনিসুল হকের নামে রয়েছে ১৭টি ব্যাংক হিসাব। এর বাইরে আনিসুল হকের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাতিজাসহ কয়েকজনের নামে আরও ১০টি ব্যাংক হিসাব আছে বলে জানা যায়।
বিগত তিন সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে জয়ী হন আনিসুল হক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে যান তিনি। গত বছরের ১৩ আগস্ট ঢাকার সদরঘাট থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। দুদকের মামলায় গত ২০ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
অন্যদিকে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সর্বশেষ তথ্যানুসারে, গত ২৪ মে ৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ৮৮টি ব্যাংক হিসাবে ৩৭৪ কোটি ৫১ লাখ টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে তৌফিকা আকতাব ওরফে তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর আগে ২৩ এপ্রিল তার ৩৮টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ এবং গত ৬ ফেব্রুয়ারি তৌফিকা করিমের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* ২০১৯ ও ২০২০ সালের বিভিন্ন সময়ে ৪০ দফায় টাকা গ্রহণ করা হয় * তদবির বাণিজ্যে আনিসুল হক আত্মীয়দের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেন * আত্মীয়দের ব্যাংক হিসাবগুলোর বিবরণী দুদকে জমা দেয়া হয়েছে
ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে ৭৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক
- আপলোড সময় : ০৪-০৭-২০২৫ ০৮:৫৮:২৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৭-২০২৫ ০৮:৫৮:২৫ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ